Sunday, February 13, 2022

“জ্ঞানই পুণ্য, পুণ্যই জ্ঞান”- উক্তিটির আলোকে সক্রেটিসের জ্ঞানতত্ত্ব ও নীতিতত্ত্ব আলোচনা কর। অথবা, 'Knowledge is virtue, virtueis knowledge'-উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

জ্ঞানই পুণ্য, পুণ্যই জ্ঞান

জ্ঞানই পুণ্য, পুণ্যই জ্ঞান : সক্রেটিসের দর্শনের মূলকথা হলো 'Knowledge is virtue or virtue is Anowledge' অর্থাৎ, জ্ঞানই পুণ্য বা পুণ্যই জ্ঞান। নিম্নে 'জ্ঞানই পুণ্য, পুণ্যই জ্ঞান' এ উক্তিটির আলোকে সক্রেটিসের নীতিতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো:
✓১. প্রকৃত জ্ঞান : সক্রেটিসের মতে, জ্ঞান দু'ধরনের হতে পারে। যথা: সার্বিক জ্ঞান ও যথার্থ জ্ঞান। তিনি বলেন, সার্বিক জ্ঞানই সর্বোৎকৃষ বা প্রকৃত জ্ঞান। তাঁর মতে, "Knowledge is the universal not of particular." সমস্ত সত্য জ্ঞান সার্বিক ধারণার মাধ্যমে অর্পণ করা যায়। 
✓২. নৈতিক জ্ঞান : সক্রেটিসের মতে, মানুষের নৈতিক জ্ঞান হচ্ছে জীবনের অমূল্য সম্পদ। জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্রের জ্ঞানকে তিনি খুব বেশি মূল্যবান বলে মনে করেন না।  জ্ঞান প্রজ্ঞার উপর নির্ভরশীল। প্রজ্ঞার মারফতই আমরা বস্তুগত সত্যতা নির্ধারণ করতে পারি। 
✓৩, জ্ঞানের জন্য আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন : সক্রেটিস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, নির্বিচার বিশ্বাস ও কুসংস্কারের হাত প্রাণী বা জাতির সকলের মধ্যে যে সাধারণ ও আবশ্যক জ্ঞান থাকে তাকে বলে সার্বিক জ্ঞান। সার্বিক জ্ঞানই বস্তুর যথার্থ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ হলো জ্ঞান। জ্ঞানের অপূর্ণতা ও অকিঞ্চিৎকরতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার মাধ্যমেই মানুষের পক্ষে জ্ঞানের নামে প্রচলিত যে কোনো অসার লৌকিক ধারণার প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। 
✓৪. প্রজ্ঞা সার্বিক ধারণার ধীশক্তি : সক্রেটিস বলেন যে, প্রজ্ঞা সার্বিক ধারণার ধীশক্তি (Faculty)। প্রজ্ঞা দু'ভাবে হতে পারে। প্রথমত আবরোহ এবং দ্বিতীয়ত আরোহ। বিশেষ বস্তু বা ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করে যে সাধারণ সত্য বা নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা হয় তাকে সামান্যকরণ বলে এবং সামান্যিকরন কেবলমাত্র আরোহ পদ্ধতি দ্বারা সম্ভব।
✓৫. জ্ঞানই সদৃদ্গুণ : সক্রেটিস জ্ঞান এবং সদ্‌গুণকে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছেন যে, যাবতীয় অন্যায় ও খারাপ কাজ জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে ঘটে থাকে। জ্ঞানের পরিবর্তে অজ্ঞতাই এখানে কাজ করে। জেনেশুনে কেউ অন্যায় করতে পরে না। তাঁর মতে, জ্ঞানের অভাব থেকেই যাবতীয় অনৈতিক আচরণের উদ্ভব ঘটে। সদগুণ এবং জ্ঞান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
✓৬. স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চিন্তার দ্বারা জ্ঞানার্জন : সক্রেটিসের মতে, যথার্থ শিক্ষাগ্রহণের জন্য মনকে সর্বপ্রকার কালিমা ও অপ্রামাণিক বিশ্বাস থেকে মুক্ত করা দরকার। আর এর জন্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। তাই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে এর ভিত্তি ও যৌক্তিকতা পরীক্ষা করে দেখা প্রত্যেক মানুষেরই কর্তব্য। অর্থাৎ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চিন্তা সঠিক জ্ঞানের জন্য অপরিহার্য সত্য।
✓৭. প্রজ্ঞাই মানুষের ধর্ম : সক্রেটিস প্রজ্ঞা বা বোধিকে (Understanding) জ্ঞানের প্রধান উপায় বলেছেন। তাঁর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা অভিন্ন ও একা। প্রজ্ঞাই মানুষের ধর্ম, মনুষ্যত্বের বিশেষ লক্ষণ। প্রজ্ঞার কল্যাণেই মানুষ ইতর প্রাণীর চেয়ে স্বতন্ত্র ও উচ্চতর। তাই প্রজ্ঞার মাধ্যমে জ্ঞানের প্রামাণ্য ও যথার্থতা যাচাই করতে হবে।
✓৮. জ্ঞান থেকেই পুণ্যের উৎপত্তি : সক্রেটিসের মতে, পুণ্যের উৎস হলো পাণ্ডিত্য বা জ্ঞান। আমরা সাধারণত মেজাজ, বিজ্ঞতা,পরিণামদর্শিতা, সদিচ্ছা, দয়া প্রভৃতি পুণ্যের কথা উল্লেখ করি। কিন্তু সক্রেটিস বলেন যে, এক জ্ঞান থেকেই এসব বিশেষ বিশেষ গুণোর উৎপত্তি। জ্ঞান বা পাণ্ডিত্যের ভিতরই অন্য সব পুণ্য লুকিয়ে আছে। 
✓৯. আত্মজ্ঞান অর্জন : সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে "Know the self" বা নিজেকে জান। তাঁর মতে, মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো আত্মজ্ঞান অর্জন করা অর্থাৎ নিজেকে জানা। আত্মজ্ঞানের মহান ব্রত নিয়েই সক্রেটিস তার উৎসর্গ করেন।
✓১০. জ্ঞানই নৈতিকতার ভিত্তি : জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যার ন্যায় নৈতিকতাতেই সক্রেটিসের ছিল সমধিক আগ্রহ। এরিস্টটল সুস্পষ্টভাবেই বলে গেছেন যে, সক্রেটিস নৈতিক বিষয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তিনি নৈতিকতাকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে জ্ঞানের সাথে একে পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ করেন।
{সমালোচনা : 'জ্ঞানই পুণ্য’ পুণ্যই জ্ঞান- এ উক্তির আলোকে সক্রেটিসের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের গুরুত্ব থাকলেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। 
এর সমালোচনাসমূহ নিম্নরূপ : 
প্রথমত, সক্রেটিসের মতে, সবকাজই প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত। এর সমালোচনায় এরিস্টটল বলেন যে, সক্রেটিস মানবাত্মার জবাবেগ, অনুভূতি এবং সংবেদন টাকে একেবারে অবহেলা করেছেন কিংবা আদৌ এ দিকটা আলোচনা করতে ভুলে যান।
দ্বিতীয়ত, প্রজ্ঞা যদি মানুষের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকে, তাহলে ন্যায় ও শুভর ধারণা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কি করে? এ ব্যাপারটি সক্রেটিস ব্যাখ্যা করে দেখাতে পারেন নি।}
দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে সক্রেটিস ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন প্রজ্ঞার সন্ধানে নিয়োজিত এমন একজন আদর্শবাদী দার্শনিক, যার মতবাদ এবং আদর্শ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে দুই হাজার বছর ধরে প্রভাবিত করেছে।

No comments:

Post a Comment

জালাল উদ্দিন রুমির বানী। Jalal uddin rumir bani. Jalal ad-din Rumi's words

তুমি সাগরে এক বিন্দু পানি নও। তুমি এক বিন্দু পানিতে গোটা এক সাগর। আমাদের মধ্যে এক অদৃশ্য শক্তি লুকিয়ে আছে। এটা যখন দুটো বিপরীতমুখী বাসনার ...